দুপুরের আহারের পর সৌম্য বরাবরই ঢোলে পড়ে বিছানায় গল্পের বই নিয়ে। বইয়ের নেশায় মাতাল হয়ে ওঠে একেবারে। ইহজগত সম্পর্কে আর কোন ধ্যানজ্ঞানই থাকে না। সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলি বইয়ের পাতায় আবদ্ধ হয়ে যায়। সৌম্য বলে বই ছাড়া জগৎ অচল ,প্রাণহীন, আবেগহীন ,উৎকণ্ঠাহীন। এই বিষয় নিয়ে ওর সাথে আমার তর্কও বাঁধে খুব।
– কি করে? বই ছাড়া মানুষ বাঁচে না কি?
– আহা ! বাঁচবে না কেন। তবে তফাৎ আছে?
– তফাৎ ! কিসের তফাৎ?
– ও ,তুই বুঝবি না। তবে তফাৎ আছে।
গত তিনমাস হলো আমার বন্ধুটির মুখটি দেখিনি। আগে প্রায়ই ওর বাড়িতে যেতাম। তারপর ওই আমাকে বারণ করেছিল ওর বাড়িতে আসতে ।তারপর থেকে আর যাওয়া হয়নি। আজ সৌম্য আমাকে দুপুরে ওর বাড়িতে ডেকেছে। আমি , সৌম্য খুব ছোটবেলার বন্ধু। আমার বন্ধুটি বইভক্ত খুব আর আমি ঠিক তার উল্টো, খেলাধূলোই প্রাণ। ওর চাপে পড়ে অনেকগুলো বই যদিও পড়েছি কিন্তু তার অর্থ মগজে এখনও ঢোকেনি। সব কবিতার বই যে। ওর সাম্রাজ্যে পদার্পণ করেই দেখি রাজকুমার বইয়ে ডুবে গেছেন।
– এই যে বন্ধুবর, হঠাৎ তলব কিসের?
মৃদু হেসে স্নিগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে সৌম্য বলল-বনলতা
– কি! মাথা ঠিক আছে সৌম্য?
– হুঁম। আজ আমি একজনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি, পীহু। এ আনন্দ তুই ছাড়া কে বুঝবে আর!
– তা জানতে পারি কি আমার বন্ধুর নতুন আবিষ্কারটা কি ?
– এই নে, দ্যাখ।
দেখি আমার বন্ধুটির মাতাল হওয়ার কারণ আজ গল্পের বই নয় কবি জীবনানন্দ দাশের লেখা কবিতার বই। বইটির সাথে আমি পরিচিত। সৌম্য দিয়েছিল আমাকে।
– এ তো কবিতার বই। সৌম্য বই আমার ভালো লাগে না । আমাকে আর বোঝাস না।
সৌম্য কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। নীল ঝকঝকে শুভ্র আকাশে হঠাৎই যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। সৌম্য গম্ভীরভাবে বলল- নাই ভাল লাগলো । তবুও আজ দেখতেই হবে তোকে।
– ঠিক আছে , ঠিক আছে দেখছি।
সৌম্য আমার সামনে কবি জীবনানন্দ দাশের লেখা ‘বনলতা সেন ‘ কবিতাটি তুলে ধরে বলল – এই সেই কবিতা যা আজ আমার নতুন আবিষ্কার। আমার ক্লান্ত প্রাণও আজ কবির মতো তার বনলতা কে খুঁজে পেয়েছে,পীহু। পাখির নীড়ের মতো চোখে চোখ রেখে আমার অশান্ত হৃদয়ও আজ এক শান্ত সমুদ্র।
– মানে ? কবিতা পড়ে তুই কি কবি হয়ে গেলি নাকি ! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।
সৌম্য বলে উঠল – আমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ তোমারি জীবন মাঝে।
– ইচ্ছা ! কি ইচ্ছা সৌম্য?
– গত তিনমাস আমার বাড়িতে তোকে আসতে বারণ করেছিলাম, তাই না। তুই কোন কারণই জানতে চাসনি।
– হ্যাঁ তা তো বলেছিলি। আমি ভেবেছিলাম আমার থেকেও তো ওই বইগুলো তোর সবথেকে প্রিয় । তাই তোদের বন্ধুত্বের মধ্যে আমি আর ব্যাঘাত ঘটাতে চাইনি।
সৌম্য হেসে উঠল খুব। তারপর অশ্রুসজল চোখে বলে উঠল – পীহু, আমার জীবনের ক্যালেন্ডারটা যে এবার ফুরিয়ে এসেছে রে। কখন যে ফাঁকি দিয়ে চলে যাব এই সুন্দর পৃথিবীটাকে ছেড়ে……
আমি নির্বাক হয়ে সৌম্য এর দিকে চেয়ে রইলাম কয়েক মুহূর্ত। ভাবলাম – এ কি বলছে সৌম্য!
– কি হয়েছে সৌম্য? আমি তো তোর চোখে আনন্দ ছাড়া কখনো এই যন্ত্রণার অশ্রু দেখিনি। জীবনের ক্যালেন্ডার ফুরিয়ে এসেছে এসব কি সৌম্য!
– ব্রেন ক্যান্সার নিয়ে আর ক’দিন চলবে ,পীহু। আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম কবিতা হয়ে ওঠার ,গান হয়ে ওঠার ,গল্প হয়ে ওঠার। তা বুঝি আর হলো না।পারবি পীহু আমার এই ক্ষণস্থায়ী স্বপ্নকে চিরন্তন করতে?
আমি হতবাক হয়ে যখন দাঁড়িয়ে আছি সৌম্য আমার হাতে ওর কবিতার ডায়েরিটা তুলে দিয়ে বলল – না হয় দেহের মরন হবে। কিন্তু আমার প্রাণটা এই ডায়েরির প্রতিটি পাতায় আবদ্ধ। তার মরণ কি করে হয়। আমায় আগলে রাখিস , পীহু।
আজ সৌম্য’র জন্মদিন। দু’বছর হল সৌম্য সকলকে ছেড়ে কোথায় হারিয়ে গেছে। ও যেতে চাইনি ওকে কেউ নিয়ে গেছে ওর নিষেধের বেড়া ডিঙিয়ে। আজ সৌম্য’র লেখা কবিতার ডায়েরিটা হাতে নিয়ে ওর আবিষ্কার করা শেষ জীবনের শেষ মুহূর্তের বনলতার কথা মনে পড়ছে। যার কাছে ও রেখে গিয়েছে ওর সবকিছু। যাকে দিয়ে গিয়েছে ওর অপূর্ণ স্বপ্ন। যাকে ও বানিয়ে গিয়েছে জীবন সায়াহ্নের ধ্রুবতারা।।
|
“আকাঙ্ক্ষা সাহিত্য পত্রিকা” য় সকলকে স্বাগত। আপনি যদি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হন তবে আহই যুক্ত হন আকাঙ্ক্ষা সাহিত্য পত্রিকায়। প্রতি শনিবার এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়। লেখা পাঠান [email protected] ইমেলে।
এবং “আকাঙ্ক্ষা সাহিত্য পত্রিকা” র হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হতে চাইলে ক্লিক করুন পাশে থাকা লিঙ্কে- WhatsApp
সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি চাকরির খবর সহ সমস্ত স্কলারশিপ ও সরকারি প্রকল্পের খবর সবার আগে পেতে আজই প্লে-স্টোর থেকে ডাউনলোড করুন আমাদের WB Job News অ্যাপ।
Download WB Job News Android App